যে অর্থ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-গবেষণা ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে খরচ করার কথা সেই অর্থ দিয়েই সাজানো হয়েছে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্যের বিলাসবহুল অফিস। এই অফিস সাজাতে সরঞ্জাম কেনার ক্ষেত্রেও ফাঁক-ফোকরের আশ্রয় নেয়া হয়েছে। বাজার মূল্যের চেয়ে বেশি মূল্য ধরা হয়েছে অনেক সরঞ্জামের। আর এসব টাকা ব্যয় করা হয়েছে নিয়ম বহির্ভূতভাবে অন্য খাত থেকে।
যে টাকা ছাত্র কল্যাণ ও শিক্ষা সরঞ্জাম কেনার কথা সেই টাকা দিয়ে এমন বিলাসিতা করায় ভিসির সমালোচনা করছেন অনেকেই। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র কল্যাণ ও গবেষণার টাকা অন্য খাতে ব্যয় করা নজিরবিহীন। তাও আবার অফিসের সাজসজ্জার কাজে!
তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, এই যুগে উপাচার্যের অফিস সাজাতে এই টাকা যথেষ্ট নয়। আর এই টাকা অন্য খাত থেকে ঋণ হিসেবে নেয়া হয়েছে বলেও দাবি তাদের।
জানা গেছে, এফলেম আর্কিটেক্টস নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে উপাচার্যের অফিস সাজানোর কাজ দেয়া হয়। চার ধাপে এই প্রতিষ্ঠানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ আয় ও সান্ধ্যকালীন কোর্সের অর্থ থেকে ৮৪ লাখ ৪৬ হাজার ৩০ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
এর আগে এ বছরের ১৭ জানুয়ারি এই কাজের জন্য টেন্ডার আহ্বান করে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেয় কর্তৃপক্ষ। তারও আগে গত বছরের নভেম্বরে জাবি কর্তৃপক্ষ উপাচার্যের অফিস পরিবর্তন ও সংস্কারের জন্য ইউজিসির কাছে ৮০ লাখ ৬৩ হাজার টাকা বরাদ্দ চেয়েছিল। কিন্তু ইউজিসি এ খাতে কোনো বরাদ্দ করেনি। তা সত্ত্বেও জাবি কর্তৃপক্ষ বিজ্ঞপ্তিতে টেন্ডারের সমুদয় খরচ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) দেবে বলে উল্লেখ করে।
এ বিষয়ে ইউজিসির অর্থায়ন ও হিসাব বিভাগের পরিচালক শাহ আলম জানান, জাবি ভিসির অফিস সাজাতে ইউজিসি কোনো ধরনের তহবিল বরাদ্দ করেনি। তারা চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব তহবিল থেকে অর্থ ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু ইউজিসির নাম ব্যবহার করে পত্রিকায় টেন্ডার বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা অনৈতিক কাজ।
এরপর ইউজিসির সঙ্গে কোনো আলোচনা ছাড়াই মার্চে দুইটি তহবিল থেকে ৮৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা সংগ্রহ করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে সান্ধ্যকালীন এমবিএ কোর্স থেকে ৫৬ লাখ ৯৫ হাজার এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থানীয় সম্পদ তহবিল থেকে ২৭ লাখ ৫০ হাজার টাকা সংগ্রহ করে ওই টাকা পরিশোধ করা হয়।
২০১৮ সালের ৫ জুন অনুষ্ঠিত সিন্ডেকেটর বিশেষ সভায় পাস হওয়া নিয়ম অনুযায়ী, সান্ধ্যকালীন এমবিএ কোর্স থেকে আয়ের ৩০-৪০% টাকা ছাত্র কল্যাণ, গবেষণা এবং সংশ্লিষ্ট বিভাগের অবকাঠামোগত উন্নয়নে ব্যয় করার কথা।
সরেজমিন বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন রেজিস্ট্রার ভবনে গিয়ে দেখা যায়, এই ভবনের দোতলায় ভিসির অফিসের জন্য চার হাজার বর্গফুট আয়তনের ওপর আটটি কক্ষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। এ অফিসের একটি অভ্যর্থনা কক্ষ হিসেবে ব্যবহার করা হবে। আর এই কক্ষটিতে যেন বৃষ্টির পানি না পড়ে সেজন্য ২৩ ফুট লম্বা একটি ছাউনি ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এই ৫ তলা ভবনের অন্য কোনো কক্ষে বৃষ্টি ঠেকাতে এ ধরনের কিংবা অন্য কোনো নিরাপত্তা বলয় চোখে পড়েনি।
সব মিলিয়ে উপাচার্য অফিস সাজাতে ব্যয় হয়েছে ৮৪ লাখ ৪৫ হাজার টাকা। এর মধ্যে অর্ধেকই ব্যয় হয়েছে আসবাবপত্র ও বৈদ্যুতিকে যন্ত্রপাতি কেনায়।
এফলেম আর্কিটেক্টসের জমা দেয়া আসবাবপত্রের মূল্য তালিকা থেকে জানা গেছে, উপাচার্যের নতুন অফিসের অভ্যর্থনা কক্ষের ছাউনিটি ৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা, ৪২ হাজার টাকা দামের দুই আসন বিশিষ্ট ১০টি সোফা, ২ লাখ ৬১ হাজার টাকায় একটি ফাইল কেবিনেট ছাড়াও ২ লাখ ১০ হাজার টাকায় একটি কাঠের কেবিনেট কেনা হয়েছে। অপরদিকে একটি কনফারেন্স টেবিল ২ লাখ, উপাচার্যের রুমের একটি টেবিল ৮০ হাজার এবং জানালার পর্দার কাপড় ২ লাখ ৬০ হাজার টাকা মূল্য ধরা হয়েছে।
তবে এই প্রতিষ্ঠানের মূল্য তালিকার সঙ্গে বাজার মূল্যের গরমিল দেখা গেছে। কোনো কোনো পণ্যে দাম বাজারমূল্যের থেকে দ্বিগুণেরও বেশি ধরা হয়েছে। এই কাজের দরপত্রের নথি নিয়ে একটি ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন ফার্মের সঙ্গে কথা বললে এমন তথ্যই বেরিয়ে আসে।
ওই ইন্টেরিয়র ডেকারেশন ফার্মের পরিচালক বলেন, দরপত্রে ১০ মিলিমিটার কাচের প্রতি বর্গফুটের মূল্য ধরা হয়েছে ১৪৫০ টাকা। অথচ বাজারের সবচেয়ে ভাল মানের গ্লাসের মূল্য প্রতি বর্গফুট ৫৫০ টাকা। একটি কাঠের ফ্রেমসহ উন্নতমানের আয়নার বাজার মূল্য প্রতি বর্গফুট ৪৫০ টাকা। অথচ ওই প্রতিষ্ঠানটি প্রতি বর্গফুট আয়নার দাম ধরেছে ১১১০ টাকা।
এসব বিষয়ে জানতে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলামের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার সাক্ষাৎ পাওয়া যায়নি। এছাড়া একাধিকবার মুঠোফোনে কল দেয়া হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
তবে এর আগে এসব বিষয়ে একটি দৈনিককে উপাচার্য বলেন, ‘এটি একটি নতুন অফিস। একই সঙ্গে আপনাকে মনে রাখতে হবে- এটি ভাইস চ্যান্সেলরের অফিস। এই ব্যয়টি কেবল আমার কক্ষের জন্য নয়, পুরো অফিসের জন্য। সে হিসেবে ৮৪ লাখ টাকা যথেষ্টও নয়। শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বা ইউজিসির মতো অফিসগুলিতে যেতে পারেন, সেগুলো আরও জাঁকজমক।’
উপাচার্য আরও বলেন, ‘আমি এই অফিসে চিরকাল থাকব না। আমি আর মাত্র দুবছর এই পদে থাকব। তারপর অন্য উপাচার্য এটি ব্যবহার করবেন। দেশে জীবনযাত্রার মান অনেক উন্নত হয়েছে। এর আগে আমাকে সরকার থেকে একটি গাড়ি দেয়া হয়েছিল, যার দাম ছিল ৬৭ লাখ টাকা। আমি এখনও এটি ব্যবহার করছি। কিন্তু এখন দুজন উপ-উপাচার্যের জন্য যে গাড়ি দুটি দেয়া হয়েছে তার মূল্য ৯৪ লাখ টাকা। এগুলো অস্থাবর সম্পত্তি। আর এসব অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে কেন আমার পেছনে লেগেছেন? আমি বুঝতে পারি না।’
দরপত্র বিজ্ঞপ্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, ইউজিসি আমাদের ‘আশ্বাস’ দিয়েছে, এটি যদি চলতি অর্থবছরে তহবিল সরবরাহ করতে না পারে তবে তারা পরবর্তী অর্থবছরে পাব। তাই আমরা ইএমবিএ এবং স্থানীয় সংস্থার তহবিল থেকে এই অর্থ ঋণ হিসেবে নিয়েছি।
অন্যদিকে উপাচার্য অফিস সাজাতে ইএমবিএর টাকা ব্যয় করার কড়া সমালোচনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. খবির উদ্দিন বলেন, ‘শিক্ষা-গবেষণার টাকা এভাবে অন্য খাতে ব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। এটা নিঃসন্দেহে অনিয়ম। গবেষণা খাতে আমাদের বরাদ্দ কম। আবার যেখানে গবেষণা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার কথা সেখানে এই টাকা অন্য খাতে ব্যবহার করা হচ্ছে।’
অধ্যাপক জামাল উদ্দিন রুনু বলেন, ‘ইএমবিএর টাকা ব্যবহারের নীতিমালা রয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে তা মানা হয়নি। আর ইউজিসির অনুমোদন ছাড়াই এ ধরনের বিলাসবহুল ডেকোরেশনের কাজ করা হয়েছে।’