ইরানের বিপ্লবী গার্ডের (আইআরজিসি) অভিজাত শাখা কুদস বাহিনীর প্রধান মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধস্বরূপ ইরান হঠকারী কোনো সিদ্ধান্ত নেবে না বলে মন্তব্য করেছেন আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও নিরাপত্তাবিষয়ক গবেষক আলতাফ পারভেজ।
তিনি বলেন, ইরান চট করে কাশেমির রিপ্লেস করতে পারবে না। তবে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ পরিস্থিতি আরও সম্প্রসারিত হবে এবং যেখান থেকে ইরান আর পিছু হটবে না।
শুক্রবার (৩ জানুয়ারি) ভোরে বাগদাদ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি মার্কিন বাহিনীর হামলায় নিহত হন। এই হত্যাকাণ্ডের পর আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফের উত্তেজনা শুরু হয়েছে।
জেনারেল সোলাইমানি নিহত হওয়ার ঘটনায় বিাংলা২৪ বিডি নিউজের পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়া হয় বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজের কাছে।
মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানির নিহতের ঘটনা কীভাবে মূল্যায়ন করছেন?
ইরান তো আসলে পারস্য সভ্যতা ধারণ করে চলে। পারস্য সভ্যতার বিবেচনায় কাসেম সোলাইমানি ছিলেন অত্যন্ত মেধাসম্পন্ন এক ব্যক্তিত্ব। যিনি এই সভ্যতা ধারণ করে এবং ইসরাইলকে মোকাবিলা করার মধ্য দিয়ে বিশ্বের সেরা জেনারেলে পরিণত হয়েছিলেন।
তিনি ইরানকে নিয়ে গেছেন ইসরাইলি সীমানায়। ইরানকে নিয়ে গেছেন গাজায়, লেবাননে, আফগানিস্তানে। আর ইরাকে তো বটেই। এই সামরিক সম্প্রসারণ নীতিতে তিনি ছিলেন অসাধারণ এক ব্যক্তি। তার এই নীতিকে আপনি পারস্য সভ্যতার পুনর্জাগরণ বলতে পারেন। ইরানের প্রতি যে অবরোধ তারও একটি প্রধানতম কারণ ছিলেন সোলাইমানি।
তিনি খুবই সাদামাটা গোছের জীবনযাপন করতেন। খুব সাধারণ একজন সৈনিকের মতো গোটা মধ্যপ্রাচ্য চষে বেড়াতেন। অথচ ইরাকে, আফগানিস্তানে, লেবাননে, গাজায়, সিরিয়ায় শক্তিশালী একটি বাহিনী তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল এই সমরবিদ। ইরাকে আইএসকে বিতারিত করেছিল তার রণনীতিই।
তার মানে অভূতপূর্ব যুদ্ধনীতিই কাল হয়ে দাঁড়াল সোলাইমানির?
সোলাইমানির অসাধারণ প্রতিভার মধ্য দিয়ে ইরান অনেকের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়ার সুযোগও পেয়েছিল। যেমন, উদাহরণ দিয়ে বলি তালেবানরা মূলত ইরানবিরোধী ছিল। অথচ কাশেম সোলাইমানি সেই বিরোধিতা দূর করে সম্পর্ক উন্নয়ন করেছিলেন। তার মানে সামরিক এবং কূটনীতিতে তার অসাধারণ পরশ ছিল। ফলে তাকে থামানো সৌদি আরবের জন্য যেমন জরুরি ছিল, তেমনি ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও জরুরি ছিল।
যুক্তরাষ্ট্র এই সময়টি বেছে নেয়ার কী কারণ থাকতে পারে বলে মনে করেন?
যুক্তরাষ্ট্র মোক্ষম সময় বেছে নিয়েছে। কারণ, এখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই হত্যাকাণ্ড দারুণ কাজে লাগবে। ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অভিশংসন হয়ে আছে। সামনে নির্বাচন। এর মধ্য দিয়ে ট্রাম্প নিজের এবং দেশের স্বার্থ উদ্ধার করার চেষ্টা করবে। একই স্বার্থ ইসরাইলের জন্যও।
ইরানের সামরিক বাহিনীতে আরও বিচক্ষণ জেনারেল আছে?
অবশ্যই আছে। কিন্তু চাইলেই ইরান চট করে কাশেমির রিপ্লেস করতে পারবে না। ইরানের অনেক মেধাবী জেনারেল আছে। নেটওয়ার্কও অনেক বড়। তবে কাশেমি ইরানের জন্য বিপজ্জনক যেটা করে ফেলেছে, সেটা হচ্ছে একপেশে নীতি অবলম্বন। এই নীতি টিকিয়ে রাখতে যে ধরনের জেনারেল দরকার, তা এই মুহূর্তে ইরানে আছে কি না জানা নেই। আর এটিই একটি বড় চ্যালেঞ্জ।
মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। যুদ্ধ কী আবশ্যক হয়ে উঠল এই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে?
মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ চলছেই। ইরাক, সিরিয়া, লেবাননে যুদ্ধ চলছে। লিবিয়া, আফগানিস্তান, ইয়ামেনেও যুদ্ধ আছে। এই যুদ্ধে ইরান, সৌদি, তুরস্ক, যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল যুক্ত আছে। আরও দেশ আছে। এই যুদ্ধ আরও তীব্র হবে বলে মনে করি। ফলে ইরানের সমঝোতা করার সুযোগ নেই। কাশেমিকে হারানোর পর ইরান কারও সঙ্গে আলোচনায় বসবে, তা এখন দুরহ।
এর খেসারত ইরান নাকি অন্যদের বেশি দিতে হবে?
অনেককেই এর মূল্য দিতে হবে। ধরুন, ইরান-সৌদি যুদ্ধ লেগে গেল! তেলের দাম রাতারাতি বেড়ে যাবে। এর মূল্য বাংলাদেশকেও দিতে হবে। আবার সৌদিতে বাংলাদেশের কয়েক লাখ শ্রমিক আছে। যুদ্ধ শুরু হলে শ্রমিকদের ফেরত আসা খুবই স্বাভাবিক। তার মানে এই যুদ্ধে আমরাও পরোক্ষভাবে যুক্ত হয়ে আছি। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল চালিকা এখন রেমিট্যান্স। আর রেমিট্যান্স আসেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে।
তার মানে যুদ্ধ শুরু হলে অনেকেরই স্বার্থে আঘাত লাগবে। আর এবারে যুদ্ধের পরিধিটা বড় আকার ধারণ করতে যাচ্ছে। কারণ, ইরান হয়তো আর পেছনে ফেরবে না।
কী ধরনের প্রতিশোধ-পরায়নতা অবলম্বন করতে পারে ইরান?
আমার মনে হয় না ইরান চট করে এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধে লিপ্ত হবে। কারণ, ইরান এখনও সেই শক্তিতে নেই। আর শক্তি থাকলেও করবে না বলে আমি মনে করি। ইরান খুবই ম্যাসিউরড।
তার মানে এখানেও ইরান ধীর নীতির পরিচয় দেবে?
ইরান যুদ্ধে সম্পৃক্ত থাকবে। কিন্তু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কোনো প্রতিশোধে যাবে না। কারণ, চাইলেই এখন ইরাক, সিরিয়া, গাজা থেকে ইরান বের হয়ে আসতে পারবে না। আর এ কারণেই ইরানকে ধৈর্য ধারণ করে এগোতে হবে। আমার মনে হয়, ইরান হঠকারী সিদ্ধান্ত নেবে না।
যুদ্ধের সময়সীমা নিয়ে ইরান যথেষ্ট ম্যাসিউরড। যুদ্ধ যে দীর্ঘ সময় ধরে গড়ায়, অর্থাৎ ওয়ানডে নয় টেস্ট ম্যাচের মতো, তা ইরান ভালো করেই বোঝে। তবে চলমান যুদ্ধাবস্থা থেকে ইরান পেছনে ফিরবে বলে মনে হয় না।