বাংলাদেশে করোনা পরিস্থিতি নিয়ে যতটা না আলোচনা হচ্ছে তাঁর থেকে বেশি আলোচনা হচ্ছে করোনাকালীন সময়ে নানারকম দুর্নীতি নিয়ে। দুর্নীতির নানারকম মুখরোচক কাহিনী এখন জনগণের মুখে-মুখে। একের পর এক দুর্নীতির চাঞ্চল্যকর তথ্য বেরিয়ে আসছে, মানুষ হতবাক হয়ে যাচ্ছে এই সমস্ত দুর্নীতির ফিরিস্তি দেখে। প্রশ্ন উঠেছে যে, এই দুর্নীতিবাজরা কি নিজেরাই দুর্নীতি করেছে নাকি তাঁদের পেছনে কোন মদদদাতা বা গডফাদার ছিল? সাধারণ মানুষ মনে করে যে, মিঠুর একার পক্ষে কারো পৃষ্ঠপোষকতা বা নেপথ্যে সহযোগিতা ছাড়া এই ধরণের লাগামহীন দুর্নীতি করা সম্ভব নয়। কারো পৃষ্ঠপোষকতা বা মদদ ছাড়া জেএমআই-এর পক্ষে এই ধরণের নকল মাস্ক সরবরাহ করা সম্ভব নয়। জেকেজির পক্ষে এককভাবে সম্ভব নয় নমুনা সংগ্রহ না করেই রিপোর্ট প্রকাশ করা বা রিজেন্ট হাসপাতালের মালিক সাহেদের লাগামহীন প্রতারণা কারো পৃষ্ঠপোষকতা বা মদদ ছাড়া অসম্ভব ব্যাপার। সাধারণ মানুষ এটাই বিশ্বাস করে। তাই দুর্নীতির এই চাঞ্চল্যকর তথ্য যা রূপকথাকেও হার মানায়, সেই কাহিনীর সঙ্গে সঙ্গে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে এদের মদদদাতা কারা, এদের গডফাদার কারা এবং গডফাদারকে আইনের আওতায় না আনা হলে এই ধরণের দুর্নীতি বন্ধ হবে না।
বিশ্লেষকরা বলছেন যে, এক মিঠুকে হয়তো কালো তালিকাভুক্ত করা হবে, কিন্তু নতুন মিঠুর জন্ম হবে, এক জেএমআই-এর আব্দুর রাজ্জাক হয়তো ভুয়া মাস্ক দেওয়া বন্ধ করবে। কিন্তু আরেকটি নতুন আব্দুর রাজ্জাক তৈরি হবে, আরেকটি নতুন জেএমআই তৈরি হবে। এক জেকেজি’র করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়া বন্ধ হয়েছে, কিন্তু আরো কত জেকেজি আছে সেখবর কে রাখে? সাহেদের মতো হাসপাতাল ব্যবসা নিয়ে প্রতারণা আরো কেউ করছে কিনা তা কে জানে? এরা এই সাহস এবং ধৃষ্টতা পেয়েছে প্রশাসনের মদদে, পৃষ্ঠপোষকতায় সে ব্যাপারে কোন সন্দেহ নেই। কারণ মিঠু যেভাবে স্বাস্থ্যখাতে দুর্নীতি করেছে সেই দুর্নীতি প্রশাসন এবং উচ্চমহলের মদদ এবং পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সম্ভব নয়।
বিভিন্ন অনুসন্ধানে দেখা গেছে যে, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যিনি মন্ত্রী হয়েছেন তাঁর সঙ্গে বা তাঁর আত্মীয় স্বজনের সঙ্গে মিঠু যেকোনভাবে একটি সখ্যতা তৈরি করেছে। তাঁদের সঙ্গে মিলেমিশেই এই দুর্নীতির কাণ্ডগুলো গঠিত হয়েছে। জেকেজি’কে কেন নমুনা পরীক্ষার দায়িত্ব দেওয়া হলো। এটা কি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের একক কর্তৃত্বে করা হয়েছে নাকি তাঁকে কেউ উপর মহল থেকে নির্দেশনা দিয়েছেন? স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক যেখানে কোথাও যাননা, সেখানে তিনি জেকেজি’র কার্যক্রমের উদ্বোধনে গিয়েছিলেন কিসের আশায়? কি পাওয়ার লোভে? এই বিষয়গুলো তদন্ত হওয়া দরকার এবং এগুলো তদন্ত হলেই এই ঘটনায় যারা জড়িত তাঁদের মূল উৎস অর্থাৎ তাঁদের গডফাদারদের খুঁজে পাওয়া যাবে।
আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেছেন যে, সাহেদ যে আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক উপকমিটিতে এসেছে, নিয়মিত বৈঠক করেছে, ইফতার পার্টিতে দাওয়াত দিয়েছে- এখন সেগুলো অস্বীকার করার কোন কারণ নেই। প্রশ্ন হলো যে কে তাঁকে দাওয়াত দিয়েছে, কিভাবে সাহেদ এখানে এসেছে এবং কিভাবে সে আওয়ামী লীগের পরিচয় ব্যবহার করেছে? একইভাবে যারা সাহেদকে বিভিন্ন টকশোতে এনেছে তাঁদেরও যোগসাজশ কতটুকু, তাঁরা কি কারণে সাহেদকে সুশীল মনে করলো, তাঁরা কিভাবে সাহেদকে টকশোতে কথা বলার যোগ্য মনে করলো সেই বিষয়টিও তদন্ত হওয়া দরকার বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। কারণ বাংলাদেশে দেখা যায় যে, যারা অন্যায় করে তাঁদেরকে ধরা হয়। কিন্তু সরকারি খাতের টাকা আত্মসাৎ করা এরকম এককভাবে সম্ভব নয়। সরকারি খাতে অর্থ প্রবাহের নীতি এবং পদ্ধতিগুলো এমন যে, এককভাবে এটা করা সম্ভব নয়। সেই বাস্তবতায় এখন যে প্রশ্নটি উঠেছে, এই সমস্ত প্রতারক, দুর্নীতবাজদের গডফাদার কে, তাঁদেরকে আইনের আওতায় আনতে হবে।