অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় কেউ মারা গেলে পরিবারের সদস্যরা গর্ব করে তাকে ‘শহীদ’ বলে। কিন্তু যুদ্ধের সময় কেউ ধর্ষণের শিকার হলে তার পরিবারের সদস্যরা বলতে পারে না তিনি ‘ধর্ষিত’। এই যুক্তি দেখিয়ে আমি বলেছি, এই দুটি অভিযোগে যেন সৈয়দ কায়সারের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়।
গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক কৃষি প্রতিমন্ত্রী সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের রায় ঘোষণার জন্য আপিল বিভাগে দিন ধার্যের পর মঙ্গলবার সুপ্রিমে কার্টে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে এসব কথা বলেন তিনি।
মাহবুবে আলম বলেন, এই মামলায় আমি আবেদন করেছি, একজন মানুষকে হত্যা করলে তখনই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ধর্ষিতার জন্য প্রতিদিনই মৃত্যু। এটা তার জন্য মৃত্যু, পরিবারের জন্য মৃত্যু। তাই কায়সারের মামলায় ধর্ষণের দুটি অভিযোগে তার যেন মৃত্যূদণ্ড দেয়া হয় সেই যুক্তি তুলে ধরেছি।
তিনি আরও বলেন, সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারের মামলার দীর্ঘদিন শুনানির পর আজকে শেষ করা হয়েছে। রায়ের জন্য আগামী ১৪ জানুয়ারি দিন ধার্য করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে ১৬টি অভিযোগ আনা হয়েছিল। দুটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে খালাস দিয়েছেন। বাকি ১৪টি অভিযোগের মধ্যে সাতটি অভিযোগে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আর চারটি অভিযোগে তাকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়েছেন আদালত। একটি অভিযোগে ১০ বছর, একটিতে সাত বছর ও আরেকটিতে পাচঁ বছর সাজা দেয়া হয়েছে।
অ্যাটর্নি জেনারেল দাবি করেন, আমি আজকে আদালতে জোরালোভাবে আবেদন জানিয়েছি, যে দুটি অভিযোগে কায়সারকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে তার মধ্যে একটি হলো- হিরামনি শাওতালকে ধর্ষণের জন্য পাকিস্তানি আর্মিকে ইশারা দিয়ে ভেতরে পাঠানো হয়। পরে তাকে ধর্ষণ করা হয়। এর ফলে তার গর্ভে একটি সন্তান জন্ম নিয়েছিল। সেই সন্তানটি দেখতে শাওতালদের মত না। এ কারণে অনবরত ধিক্কার পেতে থাকে শিশুটি। পরে সে আত্মহত্যা করে।
তিনি বলেন, আরেকজন ছিলেন মাজেদা। যাকে আসামি কায়সার পাক বাহিনীর হাতে তুলে দিয়েছিল। তিনিও ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। তারও একটি মেয়ে সন্তান জন্ম নিয়েছিল। সে মেয়েটিও সারাটি জীবন ধিকৃত হয়ে জীবনযাপন করেছে। যেহেতু আগের মামলাগুলোতে সচারাচর মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়নি, এই মামলায় আমি আবেদন করেছি, একজন মানুষকে হত্যা করলে তখনই শেষ হয়ে যায়, কিন্তু ধর্ষিতার জন্য প্রতিদিনই মৃত্যু। এটা তার জন্য মৃত্যু, পরিবারের জন্য মৃত্যু।
এর আগে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে মৃত্যুদণ্ডের খালাস চেয়ে করা সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জাতীয় পার্টির নেতা সৈয়দ মো. কায়সারের আপিলের রায় ঘোষণার জন্য আগামী ১৪ জানুয়ারি দিন ধার্য করেন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ।
কায়সারের আপিল উভয় পক্ষের শুনানি শেষে মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ রায় ঘোষণার এই তারিখ ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে এটি আপিল বিভাগের নবম মামলা, যা আপিলে নিষ্পত্তি হচ্ছে।
আদালতে সৈয়দ কায়সারের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন এসএম শাহজাহান। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রাষ্ট্রপক্ষ কায়সারের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন।
গত ১০ জুলাই এ আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ গঠন করে যুদ্ধাপরাধ সংঘটনকারী হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ও শান্তি কমিটির সদস্য সৈয়দ মোহাম্মদ কায়সারকে ২০১৪ সালের ২৩ ডিসেম্বর সর্বোচ্চ সাজা মৃত্যুদণ্ডসহ পৃথক অভিযোগে ২২ বছরের কারাদণ্ড দেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।
মুক্তিযুদ্ধকালে ১৫২ জনকে হত্যা-গণহত্যা, দুই নারীকে ধর্ষণ, পাঁচজনকে আটক, অপহরণ, নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায় এবং দুই শতাধিক বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুণ্ঠন, ষড়যন্ত্রসহ কায়সারের বিরুদ্ধে গঠন করা ১৬টি অভিযোগের মধ্যে ১৪টিই সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়। এর মধ্যে ধর্ষণের দুটিসহ সাতটি অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন। বাকি সাতটি অভিযোগের মধ্যে চারটিতে আমৃত্যু কারাদণ্ড, একটিতে ১০ বছর, একটিতে সাত বছর ও একটিতে পাঁচ বছর কারাদণ্ড দেয়া হয়। তবে সর্বোচ্চ সাজা পাওয়ায় কারাদণ্ডের সব সাজা মৃত্যুদণ্ডের সঙ্গে একীভূত হয়ে যাবে।
মানবতাবিরোধী অপরাধীদের মধ্যে প্রথমবারের মতো অন্য অপরাধের পাশাপাশি ধর্ষণের দায়ে ফাঁসির আদেশ পান কায়সার। বিচারে সাঁওতাল নারী হীরামনি ও অপর নারী মাজেদাকে ধর্ষণের অপরাধ প্রমাণিত হয়। ওই দুই বীরাঙ্গনা নারী এবং ধর্ষণের ফলে বীরাঙ্গনা মায়ের গর্ভে জন্ম নেয়া যুদ্ধশিশু শামসুন্নাহার প্রথমবারের মতো ট্রাইব্যুনালে এসে কায়সারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যও দেন।
২০১৫ সালের ১৯ জানুয়ারি নিজেকে নির্দোষ দাবি করে ফাঁসির সাজা বাতিল ও বেকসুর খালাসের আরজি জানিয়ে আপিল করেন কায়সার। ট্রাইব্যুনালের রায় বাতিলের পক্ষে আপিলে মোট ৫৬টি যুক্তি দেখানো হয়।
কায়সারের বিরুদ্ধে ৪৮৪ পৃষ্ঠার ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা হয়েছে, একাত্তরে সৈয়দ কায়সার প্রথমে হবিগঞ্জ মহকুমার রাজাকার কমান্ডার ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি ৫০০ থেকে ৭০০ স্বাধীনতাবিরোধী লোক নিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের সহযোগিতা করতে নিজের নামে ‘কায়সার বাহিনী’ নামে বাহিনী গঠন করেন। তিনি নিজে ছিলেন ওই বাহিনীর প্রধান। এমনকি ‘কায়সার বাহিনী’ নামাঙ্কিত এ বাহিনীর নিজস্ব ইউনিফর্মও ছিল।
কায়সার এ বাহিনীর মাধ্যমে হবিগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর কুমিল্লায় হত্যা, গণহত্যা, মুক্তিযোদ্ধা হত্যা, ধর্ষণ, হামলা, নির্যাতন, লুটপাট, অগ্নিসংযোগসহ ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। তিনি পাকিস্তানি সেনাদের পথ দেখিয়ে বিভিন্ন গ্রামে নিয়ে স্বাধীনতার পক্ষের লোক এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ চালায়।
এরশাদ সরকারের কৃষি প্রতিমন্ত্রী কায়সার ২০১৩ সালের ২১ মে গ্রেফতার হয়েছিলেন। শারীরিক অসুস্থতার কারণে বিচারের প্রায় পুরো সময় তিনি জামিনে ছিলেন।