মোদি নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের সদ্যপ্রণীত বিতর্কিত ও মুসলিমবিরোধী নাগরিকত্ব আইন নিয়ে ক্ষোভে উত্তাল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চা উৎপাদনকারী রাজ্য আসাম। যে আইনের মাধ্যমে প্রতিবেশী তিনটি দেশ (বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান) অমুসলিম সংখ্যালঘুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়া সহজ করে দেবে।
আসামের কয়েকটি এলাকায় চলমান গণবিক্ষোভ দমন করার জন্য এর মধ্যে হাজার হাজার সেনা মোতায়েন করা হয়েছে, কারফিউ জারি করা হয়েছে এবং স্থগিত করা হয়েছে ইন্টারনেট সেবা। পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে কয়েক দফা মুখোমুখি সংঘর্ষে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। পুলিশসহ আরও অনেকে আহত হয়েছেন।
বিলটি ভারতীয় সংসদের নিম্নকক্ষ লোকসভায় পাস হওয়ার পরে আসামেই প্রথম বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। বিলটির মাধ্যমে দেশটির মুসলিম সম্প্রদায়কে দেশ থেকে বিতাড়িত করার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে কিংবা এতে ধর্মনিরপেক্ষতা হুমকির মুখে পড়ার যে উদ্বেগ রয়েছে তার সঙ্গে এই বিক্ষোভের কোন সম্পর্ক নেই।
বিক্ষোভকারীদের শঙ্কা, নতুন এই আইনের ফলে বহিরাগতদের চাপে স্থানীয় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর জাতিগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় বিলীন হয়ে যাবে। আসামে এই উত্তেজনার অন্যতম কারণ হলো উত্তরপূর্বের এই রাজ্যটি ভারতের অন্যতম জটিল ও বহুজাতির আবাসস্থল।
অহমীয়া এবং বাংলাভাষী হিন্দুরা এখানে উপজাতিদের মধ্যে বসবাস করেন। রাজ্যটির এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠী মুসলমান, সংখ্যার হিসাবে যা প্রায় তিন কোটি বিশ লাখ। ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পরপরই আসাম রাজ্যেই দেশটির দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সংখ্যক মুসলমান বসবাস করে।
ভারতের অন্যতম অস্থিতিশীল ও গোলযোগপূর্ণ রাজ্যগুলোর মধ্যে আসাম একটি। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের চারটি রাজ্যকে আসাম থেকে বের করে আনা হয়েছে এবং সেখানে বসবাসকারী তিনটি আদিবাসী গোষ্ঠী আলাদা হয়ে তাদের নিজস্ব রাজ্য গঠন করতে চায়।
ভাষাগত পরিচয় এবং নাগরিকত্ব নিয়ে সেখানকার বাসিন্দাদের মধ্যে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে। অহমীয়া ও বাংলাভাষী জনগণ সেখানকার কর্মক্ষেত্র ও সম্পদে আধিপত্য বিস্তারের জন্য তীব্র প্রতিযোগিতা করে আসছে। বাংলাভাষীরা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠায় সেখানকার আদিবাসীদের বৈধ দাবী ও আকাঙ্ক্ষাকে উপেক্ষা করছে।
কয়েক দশক ধরে সেখানে একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হল, প্রতিবেশী বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ‘অবৈধ’ অভিবাসন। আসাম, বাংলাদেশের সাথে প্রায় ৯০০ কিলোমিটার (৫৬০ মাইল) দীর্ঘ সীমান্ত ভাগাভাগি করে এবং হিন্দু ও মুসলমান উভয়েই এই সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে থাকে।
কেউ কেউ ‘ধর্মীয় নিপীড়ন’ থেকে পালিয়ে বাঁচতে এবং অন্যরা চাকরির সন্ধানে ওই রাজ্যে পাড়ি জমায়। আসামে এখন অবৈধ বিদেশিদের আনুমানিক সংখ্যা চল্লিশ লাখ থেকে এক কোটি। ১৯৮০’র দশকে ছয় বছর চলা বিদেশি-বিরোধী বিক্ষোভের সময় শত শত মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল রাজ্যটিতে।
তারপর ১৯৮৫ সালে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার এবং বিক্ষোভকারীদের মধ্যে একটি চুক্তি হয়। সেখানে দুই পক্ষ একটি বিষয়ে একমত হয় যে, ১৯৭১ সালের ২৪ শে মার্চের পরে যথাযথ কাগজপত্র ছাড়া কেউ আসামে প্রবেশ করলে তাকে বিদেশি ঘোষণা করে নির্বাসিত করা হবে।
তবে পরবর্তী তিন দশক ধরে যখন কোনও কিছুই খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি, তখন ভারতের সুপ্রিম কোর্ট পদক্ষেপ নেয় এবং সেখানকার ‘প্রকৃত’ নাগরিকদের চিহ্নিত করার লক্ষ্যে ১৯৫১ সালে রাজ্যটির জন্য প্রস্তুত করা নাগরিক পঞ্জি হালনাগাদ করার নির্দেশ দেয়।
এদিকে চলতি বছরের আগস্টে হালনাগাদ হওয়া জাতীয় নাগরিক পঞ্জির (এনআরসি) তালিকা থেকে ২০ লাখ মানুষের নাম বাদ পড়ে যায়। এক কথায়, কার্যকরভাবে তাদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নেয়া হয়। নাগরিক তালিকা প্রকাশের শুরু থেকেই ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল বিজেপি এনআরসিকে সমর্থন করে আসছে।
২০১৬ সালে হিন্দু ও আদিবাসীদের সমর্থনে বিজেপি ক্ষমতায় আসে। তবে চূড়ান্ত নাগরিক পঞ্জি প্রকাশের আগেই বিজেপি তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে জানায় তালিকাটি ত্রুটিপূর্ণ ছিল। কারণ প্রচুর বাঙালি হিন্দু ছিল তালিকা থেকে বাদ পড়ে অবৈধ অভিবাসী হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে যায়। বিজেপির জন্য অনেক শক্তিশালী ভোটার তারা।
এখন বিজেপি প্রথম তালিকার ‘ভুল’ সংশোধন করার জন্য নাগরিক পঞ্জিতে (এনআরসি) আরও একটি হালনাগাদের ঘোষণা দিয়েছে। এনআরসির সঙ্গে করা এই নতুন নাগরিকত্ব আইন, এখন পুরনো অস্থিরতাকে উস্কে দিতে পারে বলে ভয় তৈরি হয়েছে।
আসামের অহমীয়া ভাষাভাষী মানুষ যারা কিনা রাজ্যটির মোট জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক, তারা মনে করে যে, তারা বিজেপির বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হয়েছে। বিজেপি যেখানে অবৈধ অভিবাসীদের সনাক্ত ও নির্বাসিত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তার পরিবর্তে তারা আইন করে সেসব অবৈধ অভিবাসীদের নাগরিকত্ব দিচ্ছে।
মুসলিমরা আইনটি নিয়ে ক্ষুব্ধ কারণ তারা একে বৈষম্যমূলক বলে মনে করে এবং তাদেরকে এক পর্যায়ে কেবল ধর্মের ভিত্তিতে অবৈধ অভিবাসী হিসাবে আলাদা করে দেয়া হবে। বাংলাভাষী হিন্দুরা হতাশ হয়েছেন কারণ এনআরসি থেকে বাদ পড়াদের মধ্যে হিন্দুদের সংখ্যাই বেশি, সে অনুপাতে মুসলমানদের সংখ্যা তেমন নয় বলে জানা গেছে।
এছাড়াও আরও কয়েকটি বিষয়ে উদ্বেগ রয়েছে। এই আইনের আওতায় আসামের আদিবাসী অধ্যুষিত কয়েকটি অঞ্চলে বিশেষ সুরক্ষা দেয়া হয়েছে। যেনো অন্যান্য সম্প্রদায়ের অবৈধ অভিবাসীরা সেখানে বসতি স্থাপন করতে গেলে বাধার মুখে পড়ে।
তবে অনেকেই বলছেন যে, পুরো রাজ্য এই নিয়মের আওতায় না পড়ায় এই ‘সুরক্ষিত’ অঞ্চলে বাস করা অমুসলিম অভিবাসীরা আসামের অন্যান্য অঞ্চলে গিয়ে সাধারণ ক্ষমা চাইতে পারে।
ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চল বিশেষজ্ঞ সুবির ভৌমিক বিবিসিকে বলেন, ‘আমি মনে করি না বিজেপি আসামের নাগরিকত্ব আইন এবং এনআরসি-তে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া আশা করেছিল। এই ঘটনা ভারতে মুদ্রা নিষিদ্ধ করার চাইতেও বড় ধরনের বিপর্যয়ে মোড় নিতে পারে।’
অঘোষিত সম্পদের হিসাব বের করতে ২০১৬ সালে ভারতের বিজেপি সরকার ভারতে ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যা নিয়ে দেশজুড়ে ব্যাপক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। সেই উদাহরণ টেনে এমন মন্তব্য করেন সুবির ভৌমিক।
তবে এটা স্পষ্ট যে বিজেপি সাধারণ মানুষের এ ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশা করেনি। ক্ষয়ক্ষতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বৃহস্পতিবার টুইট করেন যে তার সরকার ‘আসামের জনগণের রাজনৈতিক, ভাষাগত, সাংস্কৃতিক এবং ভূমির অধিকার রক্ষায় সাংবিধানিকভাবে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’
তিনি বলেন, ‘কেউ আপনার অধিকার, স্বতন্ত্র পরিচয় এবং সুন্দর সংস্কৃতি কেড়ে নিতে পারবে না।’ শুধু প্রধানমন্ত্রী মোদি নয় তার কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনেকেই বিক্ষোভকারীদের আশ্বাস দিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী মোদিসহ সরকারের এমন আশ্বাস বিক্ষোভকারীদের শান্ত করবে কিনা তা এখনও পরিষ্কার নয়।